মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তান স্থলবেষ্টিত একটি দেশ। এর পশ্চিমে ইরান, দক্ষিণ ও পূর্বে পাকিস্তান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে তাজিকিস্তান ও চীন। আফগানিস্তানের আয়তন দুই লাখ ৫২ হাজার ৭২ বর্গমাইল। আফগানিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চল পর্বতসংকুল।
যদিও উত্তরাঞ্চলে কিছু সমতল ভূমিও আছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ৩১.৪ মিলিয়ন। তাদের বেশির ভাগ পশতু, তাজিক, হাজারা ও উজবেক নৃ-গোষ্ঠীর। কাবুল দেশটির রাজধানী ও সর্ববৃহৎ শহর। ইসলাম-পূর্ব আফগানিস্তান : প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস বলে, আফগানিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২০০০ অব্দে সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
প্রথম ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায় ইরানের আচেমেনিয়ান সাম্রাজ্যের দলিলপত্রে। যারা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ৩৩১ পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ থেকে ৩২৭ পর্যন্ত আফগানিস্তান ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটে’র অধীনে ছিল। তিনি আচেমেনিয়ান সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
এর কিছু দিন পর ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য দক্ষিণ আফগানিস্তান দখল করে এবং সেখানে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারে ভূমিকা রাখে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে যাযাবর ‘কুশান’রা একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তখন আফগানিস্তান সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। কুশানদের পর থেকে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত আফগানিস্তান ইরানের সাসানি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
আফগানিস্তানে ইসলামের আগমন : ধারণা করা হয়, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর শাসনামলে বোখারা-সমরকন্দ অঞ্চল অতিক্রম করে আফগান অঞ্চলে ইসলামপ্রচারকদের আগমন ঘটে। যদিও রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় আরো পরে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে কাদেসিয়ার যুদ্ধে সাসানীয়রা পরাজিত হওয়ার এক শ বছরের মধ্যে আফগান অঞ্চল মুসলিমদের শাসনাধীন হয় এবং আফগানিস্তানের বিভিন্ন উপজাতি ও গোষ্ঠী ইসলাম গ্রহণ করে।
৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘নাহাভান্দ’ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানরা খোরাসান জয় করলে আফগান অঞ্চল জয়ের পথ প্রশস্ত হয়। মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন : আফগান ভূখণ্ডে ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন হয় উমাইয়া খলিফাদের আমলে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিক ও ওমর ইবনে আবদুল আজিজ। উমাইয়া সেনাপতি আবদুর রহমান ইবনে সামুরা জানবিলদের পরাজিত জাবুলিস্তান (দক্ষিণ আফগানিস্তান) জয় করেন।
আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিমের সময় সমগ্র আফগানিস্তান মুসলিমদের অধীনে আসে এবং ইসলাম আফগানিস্তানের সর্বসাধারণের ধর্মে পরিণত হয়। আব্বাসীয়দের অধীনে সামানিদরা (৮১৯-৯৯৯ খ্রি.) আফগানসহ মধ্য এশিয়ার কিছু অঞ্চল শাসন করত। দশম খ্রিস্টাব্দে সামানিদদের পতন হলে আফগানিস্তানে গজনভি সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। গজনভিদের শাসনকালেই আফগানিস্তান প্রথমবারের মতো বৃহত্তর পরিসরের কোনো ইসলামী শাসন লাভ করে।
১২২০ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র মধ্য এশিয়ার মতো মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান দ্বারা আক্রান্ত হয়। ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তান বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। এরপর তৈমুর লং আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তার পরিবার ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত তা শাসন করে। আফগানিস্তানে পশতু শাসন : ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত নতুন মোগল সাম্রাজ্যের অধীন হয় আফগানিস্তান।
পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা পরবর্তী দুই শ বছর ইরানের সাফাভিদ সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ১৭৪৭ সালে সাফাভি সম্রাট নাদির শাহের মৃত্যুর পর আফগানিস্তানে পশতু শাসনের উত্থান ঘটে, যারা দুররানি নামে বেশি পরিচিত। নামে মাত্র হলেও ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন অব্যাহত ছিল। দুররানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানি, যিনি আহমদ শাহ আবদালি নামেও পরিচিত; তিনি আফগানিস্তানের পশতু জাতিগোষ্ঠীকে একত্র করেন। তাঁকে আফগান জাতির পিতাও বলা হয়।
আহমদ শাহ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তার শাসন ভারতের দিল্লি থেকে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১৭৭২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। কিন্তু ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে পশতু নেতা দোস্ত মুহাম্মদ আফগানিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। আফগানিস্তানে বিদেশি আগ্রাসন : দোস্ত মুহাম্মদ এমন সময় আফগান শাসন শুরু করেন, যখন আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে ‘গ্রেট গেম’ শুরু হয়।
তবে আফগান শাসকরা কিছুটা সমঝোতা করে হলেও তখন আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হন। প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ব্রিটিশরা দোস্ত মোহাম্মদকে পরাজিত করে। কিন্তু দুই বছরের মাথায় ১৮৪২ সালে আফগান রণক্ষেত্র ত্যাগ করে। এ সময় রাশিয়া আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটেন আফগানিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নিতে সক্ষম হয়।
১৮৮০ সালে আবদুর রহমান খান দুররানি আফগানিস্তানের শাসক হন এবং তাঁর সময়ে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে সীমান্ত (ডুরান্ড লাইন) নির্ধারিত হয়। ১৯০১ সালে তাঁর ছেলে হাবিবুল্লাহ আফগানিস্তানের শাসক হয় এবং তাঁর আমলে রাওয়ালপিণ্ডি চুক্তির মাধ্যমে ১৯ আগস্ট ১৯১৯ আফগানিস্তান পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। হাবিবুল্লাহর পর আফগানিস্তানের শাসক হন তাঁর ছেলে আমানুল্লাহ। তাঁর পর শাসক হয় আমানুল্লাহর নাতি মুহাম্মদ জহির শাহ; তিনি আফগানিস্তানের শেষ বাদশাহ। ১৯৩৩ সালে জহির শাহ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়।
তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও চাচাতো ভাই মুহাম্মদ দাউদ ১৯৭৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটালে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছায়। এরপর থেকে আর কোনো দিন আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। দুই পরাশক্তির বিদায় : আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে শাসকদের সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার ৮০ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে প্রবেশ করে।
তবে সাধারণ আফগান জনগণ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ এক দশকের যুদ্ধের পর ১৯৮৯ সালে তারা আফগানিস্তান ত্যাগ করে। রাশিয়ার বিদায়ের পর তালেবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আসে। তবে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আফগানিস্তানে আক্রমণ করে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধের পর ৩১ আগস্ট ২০২১ তারাও আফগানিস্তান ত্যাগ করে। এরপর আবারও ক্ষমতা গ্রহণ করে তালেবান।
তথ্যসূত্র : ন্যাশনস অনলাইন ডটঅর্গ, আল জাজিরা ও উইকিপিডিয়া
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।